শুক্রবার রেললাইনের ধারে দাঁড়িয়ে মোবাইলে নিজস্বী তুলতে গিয়ে প্রাণ গেল কল্যাণী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র সৌরভ দে-র (২১)। শুক্রবার দুপুরে কল্যাণীর শিল্পাঞ্চল ও ঘোষপাড়া রেল স্টেশনের মাঝে ঘটনাটি ঘটে। আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সৌরভের বন্ধু অভিষেক রায়। দু’জনেরই বাড়ি শ্যামনগর কাউগাছির রামমোহনপল্লিতে। প্রথম বর্ষের পরীক্ষার জন্য কলেজে রেজিস্ট্রেসন ফর্ম পূরণ করতে গিয়েছিলেন ওঁরা। কিন্তু জীবনের পরীক্ষাতে আর ঠিকঠাক উতরানো হল না সৌরভের। দুর্ঘটনার খবর জানানো হলেও সৌরভের মাকে চরম দুঃসংবাদটি দিতে পারেননি প্রতিবেশীরা। বার বার তিনি বলছেন, ‘‘বাড়ি ফিরলে বলে দেব, ও আর যেন মোবাইলে নিজের ছবি না তোলে।’’
বৃহস্পতিবারই অভিষেকের রেজিস্ট্রেসন ফর্ম পূরণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রিয় বন্ধুর জন্য তিনি আজও কলেজে গিয়েছিলেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি কেবল্ টিভি লাইনের কাজও করতেন সৌরভ। বছরখানেক আগে পাড়ারই মেয়ে পাপিয়ার সঙ্গে বিয়ে...
more... হয় তাঁর। কথা ছিল, কলেজের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে শ্যামনগরে ফিরবে। পৌনে দু’টো নাগাদ স্ত্রীকে সে কথা জানিয়েছিলেনও। আর তার পরেই ঘটে যায় ভয়ঙ্কর সেই ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ওই কলেজেরই কয়েকজন ছাত্র।
ঠিক কী ঘটেছিল?
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, সৌরভ প্রায় সর্বক্ষণই মোবাইলে নিজস্বী তোলার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। এ দিনও রেললাইন দিয়ে হাঁটছিলেন অভিষেক আর সৌরভ। লাইনের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজস্বী তুলতে শুরু করেন সৌরভ। সেই সময় ওই লাইন দিয়ে আসছিল আপ কল্যাণী সীমান্ত লোকাল। ট্রেন ওঁদের কাছাকাছি এসে বেশ কয়েকবার বাঁশি বাঁজায়। কিন্তু, তা কানে যায়নি দুই বন্ধুর। শেষ পর্যন্ত ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন ওরা দু’জন। কাছাকাছি থাকা কলেজের অন্যান্যরা ছুটে আসেন। তাঁরাই ধরাধরি করে জওহরলাল নেহরু মেমোরিয়াল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। অভিষেকের আঘাত তেমন গুরুতর না হলেও, সংজ্ঞা ছিল না সৌরভের। তাঁর আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল যে, তাঁকে আইসিসিইউ-তে ভর্তি করা হয়। কিন্তু, এক ঘণ্টার বেশি চলেনি তাঁর লড়াই। দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। কল্যাণী থানার পুলিশ জানিয়েছে, ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে সৌরভের।
অভিষেকের বাড়িতে আগেই খবর গেলেও, সৌরভের বাড়িতে দুর্ঘটনার খবর যায় দেরিতেই। সৌরভের বাবা উত্তম দে পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। থাকেন সাদামাটা ভাড়াবাড়িতে। তাঁর স্ত্রী ইন্দ্রাণীদেবী মানসিক ভাবে কিছুটা অসুস্থ। সন্ধ্যায় তাঁদের বাড়িতে মৃত্যুর খবর পৌঁছয়। পাপিয়াকে নিয়ে উত্তমবাবু রওনা হন কল্যাণী। যদিও ইন্দ্রাণীদেবী একবার টিভি চালিয়ে দেখে ফেলেছেন ছেলের দুর্ঘটনার খবর। তার পর থেকে প্রতিবেশিরাই টিভি বন্ধ করে দিয়েছেন। ইন্দ্রাণীদেবী বার বার জনে জনে জিজ্ঞেস করছেন, ‘‘কালই ওকে ছেড়ে দেবে তো হাসপাতাল থেকে?’’
এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ক্লাস নাইন থেকেই মোবাইলের নেশা সৌরভের। কেতাদুরস্ত পোশাক আর মোবাইলই ছিল তাঁর নেশা। বন্ধুদের বলেছিলেন, চলন্ত ট্রেনের সামনে লাইনে শুয়ে নিজস্বী তুলতে চান তিনি। কল্যাণীতে এ দিন তারই কি মহলা দিচ্ছিলেন সৌরভ? এ প্রশ্ন তাঁর বন্ধুদের।
এ বছরের শুরুতে মুম্বইয়ে ট্রেনের ছাদে উঠে নিজস্বী তুলতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ গিয়েছিল গণেশ কুমকুমওয়াতির। এ মাসের চার তারিখে মুম্বইতেই বাবার কাছ থেকে উপহার পাওয়া মোবাইল দিয়ে একই ভাবে নিজস্বী তুলতে গিয়ে তড়িদাহত হয়ে প্রাণ যায় ১৪ বছরের এক স্কুল ছাত্রের।
নিজস্বীর নেশা মানসিক বিকার কিনা, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিদেশে গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছে। রাশিয়ার মতো কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে স্কুলগুলিতে সেলফি-সচেতনতার কর্মশালা শুরুও করেছে। এ দেশেও যে কিশোর-তরুণদের সতর্ক করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, তা আরও একবার স্পষ্ট হল।